কিংবদন্তী নেতাজি:নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু
- Debjoyti Ghosh
- Jun 29
- 3 min read

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে কিছু নাম চিরকাল অমর হয়ে থাকবে, আর সেসব নামের মধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অন্যতম।যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল আমাদের দেশ, তখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন নেতাজি।মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা তাঁকে ভারতের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্রে পরিণত করেছে।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা:
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, ওড়িশার কটক শহরে। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী এবং মাতা প্রভাবতী দেবী একজন ধার্মিক ও সংস্কারপন্থী নারী। ছোটবেলা থেকেই সুভাষচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও স্বদেশপ্রেমী
১৯০২ সালে তিনি ওড়িশার কটকের ব্যাপটিস্ট মিশনস প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে ভর্তি হন এবং ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন।১৯০৯ সালে তিনি কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে (Ravenshaw Collegiate School) ভর্তি হন। এখানে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত শেখেন এবং বেদ ও উপনিষদ সম্পর্কেও শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (Presidency College) আই.এ. (ইন্টারমিডিয়েট আর্টস) পড়ার জন্য ভর্তি হন। তবে ১৯১৬ সালে একজন ব্রিটিশ অধ্যাপকের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে তাকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে (Scottish Church College) ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি ১৯১৯ সালে দর্শনশাস্ত্র (Philosophy) বিষয়ে বি.এ. (ব্যাচেলর অফ আর্টস) ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।১৯১৯ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা এবং ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ইংল্যান্ডে যান। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটজউইলিয়াম হল (Fitzwilliam Hall, Non-Collegiate Students Board) থেকে মানসিক ও নৈতিক বিজ্ঞান (Mental and Moral Sciences Tripos) বিষয়ে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

নেতাজিও আই.সি.এস. (ICS):১৯২০ সালে তিনি আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। সেই সময়ে এটি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অত্যন্ত সম্মানজনক একটি পদ ছিল।
তবে ইংরেজ সরকারের চাকরি তাঁর দেশপ্রেমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, তাই তিনি সেই চাকরি ত্যাগ করেন।দেশের প্রতি তাঁর অতুলনীয় আত্মত্যাগ তাঁকে এক কিংবদন্তী ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে নেতাজি:

গান্ধীজির সাথে নেতাজি:
নেতাজির রাজনৈতিক জীবন কংগ্রেস পার্টির মাধ্যমেই শুরু হয়। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী, তবে সময়ের সঙ্গে তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। তিনি অনুভব করেন যে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবেরও প্রয়োজন রয়েছে। এরপর তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে “Forward Bloc” গঠন করেন।নেতাজির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন
গৃহবন্দী নেতাজি:
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরজ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আপোসহীন অবস্থানের কারণে ব্রিটিশ সরকার ভীত হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে, খোলা ময়দানে সুভাষচন্দ্র থাকলে তাঁর প্রভাব আটকানো অসম্ভব। তাই, ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং কলকাতার এলগিন রোডের (বর্তমান নেতাজি ভবন) নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখে। বাড়ির চারপাশে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক প্রহরা ছিল।এই সময়টা নেতাজির জন্য ছিল এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হত, তিনি অসুস্থ এবং উপবাস করছেন, আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি এক বিরাট পরিকল্পনার জাল বুনছিলেন।১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাস। ১৬-১৭ই জানুয়ারির মধ্যরাতে, প্রবল শীতের মধ্যে নেতাজি তাঁর দুঃসাহসিক পালানোর পরিকল্পনা কার্যকর করেন। তিনি পাঠানদের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করেন, যার নাম ছিল 'জিয়াউদ্দিন'। মুখ ভর্তি দাড়ি এবং পাঠানি পোশাকে তাঁকে চেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁর ভাইপো শিশির কুমার বসু, তাঁর পরিচিত 'ওয়ান্ডারার' গাড়িটি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। এই গাড়িটি বর্তমানে নেতাজি ভবনে সংরক্ষিত আছে।পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে নেতাজি নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। শিশির তাঁকে নিয়ে প্রথমে ধনবাদ জেলার গোমো রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি 'কালকা মেল' ধরেন এবং পেশোয়ারের দিকে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথে তিনি অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আফগানিস্তান, সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে অবশেষে জার্মানি পৌঁছান।নেতাজির গৃহবন্দীত্ব থেকে এই মহানিষ্ক্রমণ ব্রিটিশ সরকারকে হতবাক করে দিয়েছিল।

বিদেশের মাটিতে নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন:
গৃহবন্দীত্ব থেকে পালিয়ে জার্মানি এবং পরে জাপানের সহায়তায় নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন এবং "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো" – এই অমর বাণী দিয়ে ভারতীয়দের অনুপ্রাণিত করেন।এই ফৌজের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করেন। যদিও সফলতা আসেনি, তবুও তাঁর প্রচেষ্টা জাতিকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করে।
রহস্যমৃত্যু:
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যমৃত্যুর উন্মোচন এখনো ঘটেনি।১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর সংবাদ আসে। তবে তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে বহু রহস্য ও বিতর্ক আজও চলছে। অনেকের মতে, তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি; বরং গোপনে জীবন কাটিয়েছেন।এই মহামানবের দহিক অবসান পত্তেক ভারতীয় কে ব্যাথিত করে তোলে।তবে তাঁর শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও, তাঁর আদর্শ, তাঁর সাহস এবং তাঁর আত্মত্যাগ আজও আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভর ও গর্বিত ভারতের, যেখানে কেউ দাসত্বে থাকবে না। আজ আমরা স্বাধীন ভারতবাসী, কিন্তু আমাদের উচিত তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শকে মনে রেখে এগিয়ে চলা।
জয় হিন্দ!
Comments