top of page

Mariana Trench বা ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ :পৃথিবীর গভীরতম রহস্যময় জায়গার অজানা কাহিনি

  • Writer: Debjoyti Ghosh
    Debjoyti Ghosh
  • Jul 7
  • 4 min read
A deep, dark ocean hole surrounded by swirling water, fish, and glowing specks. The setting is serene and mysterious under a blue surface.

আমাদের পৃথিবী এক অদ্ভুত রহস্যময় জায়গা। স্থলভাগে যেমন উঁচু উঁচু পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে, তেমনই সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে আছে বিশাল রহস্যময় জগৎ। এই রহস্যময় জগতের এক অনবদ্য অংশ হলো মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত এই সামুদ্রিক খাতটি পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম স্থান, যা আজও মানুষের কাছে এক বিশাল বিস্ময়।যেখানে মানুষ আজও পুরোপুরি পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে অন্ধকার, চাপে চূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা আর সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রাণের বাস।


ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ বা Mariana Trench কোথায় অবস্থিত এবং কি ভাবে এর উৎপত্তি হয়?

ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ অবস্থিত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের পূর্বে  ম্যারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ নামক এক দ্বীপশ্রেণির পাশ দিয়ে বিস্তৃত।

এই ট্রেঞ্চের দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫৫০ কিলোমিটার, যা ভারতের দিল্লি থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত দূরত্বের চেয়েও বেশি। এর প্রস্থ গড়ে ৬৯ কিমি হলেও কোথাও কোথাও এটি আরও বিস্তৃত।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ মূলত টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফল। প্রশান্ত মহাসাগরের যে অংশটিতে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অবস্থিত, তা ইজু-বনিন-মারিয়ানা সাবডাকশন সিস্টেমের একটি অংশ। এই সিস্টেমে দুটি টেকটোনিক প্লেট জড়িত: প্যাসিফিক প্লেট এবং মারিয়ানা প্লেট। প্যাসিফিক প্লেটটি তুলনামূলকভাবে প্রাচীন, ঘন এবং শীতল, যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে, মারিয়ানা প্লেটটি অপেক্ষাকৃত নবীন এবং উষ্ণ। এই দুটি প্লেট একে অপরের দিকে প্রতি বছর প্রায় ৩৯-৫১ মিলিমিটার বেগে ধাবিত হয়। যখন একটি প্লেট অন্যটির নিচে ঢুকে যায় (এই প্রক্রিয়াকে সাবডাকশন বলে), তখন সমুদ্রের তলদেশে বিশাল গভীর খাদের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ ১৮০ মিলিয়ন বছর ধরে এই দুটি প্লেটের সংঘর্ষের ফলস্বরূপ আজকের মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সৃষ্টি হয়েছে।


ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর গভীরতা কত?

ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মানুষের কল্পনারও বাইরে। এর সবচেয়ে গভীর অংশের নাম চ্যালেঞ্জার ডিপ (Challenger Deep), যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,৯৮৪ মিটার (৩৬,০৩৭ ফুট) গভীরে।

তুলনা করতে গেলে:মাউন্ট এভারেস্টকে যদি উল্টে এই খাতের মধ্যে বসানো হয়, তবুও তার চূড়া পানির নিচে থেকে যাবে!এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এতটাই নিচে যে, সেখানে ১,০০০ বারেরও বেশি বায়ুচাপ অনুভূত হয়, যা মানুষের দেহ এক সেকেন্ডেই চূর্ণ করে দিতে পারে।

এখানে কোনো সূর্যের আলো পৌঁছায় না, ফলে গভীর অন্ধকারে জীবনের অস্তিত্ব থাকা এক অভাবনীয় বিষয়।


মারিয়ানা ট্রেঞ্চের পরিবেশ কেমন ?

মারিয়ানা ট্রেঞ্চের পরিবেশ অত্যন্ত প্রতিকূল এবং চরম। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

  • অবিশ্বাস্য চাপ: চ্যালেঞ্জার ডিপে জলের চাপ সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের প্রায় ১,০০০ গুণেরও বেশি, যা প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ১৫,৭৫০ পাউন্ড চাপ প্রয়োগ করে! এই বিশাল চাপে মানুষের হাড় গুঁড়িয়ে যাবে।

  • অন্ধকার এবং ঠান্ডা: সূর্যের আলো এই গভীরতায় পৌঁছায় না, তাই এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্ধকার। তাপমাত্রা ১ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৪ থেকে ৩৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মধ্যে থাকে, যা প্রায় বরফ-ঠান্ডা।

  • খাদ্যের অভাব: এত গভীরে খাবার খুবই সীমিত, কারণ জলের উপরিভাগে উৎপন্ন খাবার এত গভীরে পৌঁছাতে পারে না। তাই এখানকার প্রাণী এবং অণুজীবগুলি রাসায়নিক পদার্থ, যেমন মিথেন বা সালফারের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।


গভীর সমুদ্রের ভিতরে কী আছে?

এই গহ্বরের ভিতরে জীবন আছে, এবং তা একেবারেই আলাদা। বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবিষ্কার করেছেন কিছু রহস্যময় ও অদ্ভুত প্রাণী, যেগুলো আমরা কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না।

কিছু প্রাণীর নাম:

  • জেনোফাইওফোরস (Xenophyophores): এগুলি এককোষী কিন্তু বৃহৎ আকারের অ্যামিবা, যা সমুদ্রের তলদেশে যা পায় তাই খেয়ে বেঁচে থাকে।

  • অ্যাম্ফিপডস (Amphipods): এগুলি অনেকটা চিংড়ি মাছের মতো দেখতে এবং সাধারণত মৃত প্রাণীর অবশেষ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে বাস করা জায়ান্ট অ্যাম্ফিপড আকারে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।

  • স্নেইল ফিশ (Snailfish): এই মাছগুলি বিশ্বের বিভিন্ন সাগরের গভীরতায় দেখা যায়। মারিয়ানা ট্রেঞ্চে নতুন তিনটি প্রজাতির স্নেইল ফিশের সন্ধান মিলেছে। এদের দেহ জেলির মতো নরম এবং হাড় খুবই কম, যা এদেরকে অত্যাধিক চাপে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

  • বায়োলুমিনেসেন্ট জেলিফিশ (Bioluminescent Jellyfish): ২০১৬ সালে এই আলো উৎপাদনকারী জেলিফিশের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরা ৪,০০০ মিটার গভীরে অন্ধকার রাজ্যে আলোর উৎস হিসেবে বিচরণ করে এবং আলো জ্বেলে শিকার ধরে।

  • শিকারী টিউনিকেট (Predatory Tunicate): এটি 'ঘোস্টফিশ' নামেও পরিচিত। দেখতে নিরীহ হলেও, এটি ছোট প্রাণী, যেমন প্ল্যাঙ্কটন, ধরে খায়।

এছাড়াও, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অ্যাকর্ন ওয়ার্মস, হার্মিট কাঁকড়া এবং পিং পং ট্রি স্পঞ্জের মতো অদ্ভুত প্রাণীরও সন্ধান মিলেছে।


মারিয়ানা ট্রেঞ্চে মানবজাতির অভিযান:

১৯৬০: প্রথম অভিযান-মারিয়ানা ট্রেঞ্চের রহস্য উন্মোচনে মানুষ বারবার অভিযান চালিয়েছে। প্রথম সফল অভিযান হয়েছিল ১৯৬০ সালে, যখন সুইস সমুদ্রবিজ্ঞানী জ্যাক পিকর্ড এবং মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালশ 'ট্রিয়েস্ট' নামক একটি বাথিস্ক্যাফ (গভীর সমুদ্রতলে অনুসন্ধানযোগ্য জলযান) ব্যবহার করে চ্যালেঞ্জার ডিপে পৌঁছেছিলেন। তাদের এই অভিযান বিজ্ঞানীদের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিল, কারণ তারা এত গভীরেও প্রাণের অস্তিত্ব দেখে অবাক হয়েছিলেন।

২০১২: জেমস ক্যামেরনের একক অভিযান-এরপর ২০১২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন (টাইটানিক চলচ্চিত্রের পরিচালক) ব্যক্তিগতভাবে ডিজাইন করা একটি সাবমার্সিবলে করে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে নেমেছিলেন।জেমস ক্যামেরন (Titanic, Avatar-এর পরিচালক) একাই একটি বিশেষ যান "Deepsea Challenger"-এর মাধ্যমে সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে ডুব দেন এবং সেখানকার ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। এটি ছিল প্রথম একক গভীর সমুদ্র অভিযান।

২০১৯:২০১৯ সালে মার্কিন বিনিয়োগকারী ভিক্টর ভেসকোভো ১০,৯২৭ মিটার গভীরে নেমে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। দুঃখজনকভাবে, ভেসকোভো ট্রেঞ্চের একদম গভীরে প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং ক্যান্ডির মোড়ক খুঁজে পেয়েছিলেন, যা সমুদ্র দূষণের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে।


কেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ?

1. ভূতত্ত্ব বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ

পৃথিবীর প্লেট টেকটনিকস এবং ভূমিকম্প-জলচ্ছ্বাসের উৎস বোঝার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।

2. নতুন জীববৈচিত্র্য আবিষ্কারের স্থান

গভীর সমুদ্রের প্রাণীগুলো সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। এদের নিয়ে গবেষণা করলে চিকিৎসা, জিনবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

3. জলবায়ু পরিবর্তন পর্যালোচনা

এই ট্রেঞ্চেও প্লাস্টিকের টুকরো, রাসায়নিক ও তেলের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এটি দেখায় মানুষ কীভাবে সমুদ্রের গভীরতম স্থানেও প্রভাব ফেলেছে।

4. জীবনের উৎপত্তি ও মহাকাশ গবেষণা

এখানে চরম পরিবেশেও প্রাণ থাকতে পারে দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মঙ্গল গ্রহ বা ইউরোপা (Jupiter-এর চাঁদ)-তেও প্রাণের সম্ভাবনা থাকতে পারে।


কিছু মজার তথ্য (Fun Facts):

  • এখানে আলো নেই, কিন্তু কিছু প্রাণী নিজেই আলো তৈরি করে।

  • এই গভীরতায় চাপ প্রায় ৮ টন প্রতি বর্গইঞ্চি—যা একটি বিশাল বিমানবাহী জাহাজের ওজনের সমান!

  • পৃথিবীর সমুদ্রের মাত্র ৫% এখনো মানুষ ভালোভাবে জানে — বাকি ৯৫% এখনো গবেষণার অপেক্ষায়।


মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কেবল পৃথিবীর গভীরতম স্থানই নয়, এটি মানবজাতির জন্য এক অফুরন্ত গবেষণার ক্ষেত্র। এখানকার চরম পরিবেশ, রহস্যময় প্রাণী এবং ভূতাত্ত্বিক গঠন আমাদের গ্রহ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচন করছে। যদিও মানুষ ইতিমধ্যেই চাঁদে এবং মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু আমাদের নিজস্ব সমুদ্রের মাত্র ২০% এলাকা মানচিত্রভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো গভীর সমুদ্রের খাতগুলি এখনও বহু রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, যা ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ এবং অনুপ্রেরণা। এই অতল গভীরতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবী কতটা বিচিত্র এবং রহস্যময়!


Comments


bottom of page